
আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্কঃ একটি শব্দ যেন ভেঙে নিয়ে আসছে চারপাশ। স্থলভাগের সব জলধারা যেন বইছে একসাথে। এ এক প্রকৃতির অপার বিস্ময়। যে বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে গিয়ে রোমাঞ্চের জলে হাবুডুবু খান অনেক পর্যটক। কি এক অকৃত্রিম টানে বারে বার ফিরে যান ভয়ঙ্কর সুন্দর এই স্থানটিতে।
হ্যাঁ পাঠক, বলছি পানি পতনের গর্জন আর দু’চোখ ভরা বিস্ময়ের নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কথা। যার ইংরেজি নাম নায়াগ্রা ফলস। জল শব্দের অর্থ পানি, আর প্রপাত শব্দের অর্থ পতন। সেই হিসেবে জলপ্রপাতের অর্থ দাঁড়ায় পানির পতন। সহজ করে বলতে গেলে পাহাড়ি ঝর্ণার বড় রূপই হলো জয়প্রপাত। আর নায়াগ্রা নদীর পানির মাধ্যমে উৎপত্তি হওয়ায়, এর নামকরণ করা হয়েছে নায়াগ্রা জলপ্রপাত বা নায়াগ্রা ফলস।

উন্নত জীবন ধারণের দুই স্বর্গ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। তবে মজার বিষয় হলো, নায়াগ্রা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত, সাধারণ মানুষের এমন ধারণা থাকলেও এ বড় অংশ অর্থ্যাৎ তিন ভাগের দুই ভাগই কিন্তু কানাডার মধ্যে পড়েছে। কানাডায় যে অংশ পড়েছে তাকে বলা হয় কানাডিয়ান ফলস, আর যুক্তরাষ্ট্রে যে অংশ পড়েছে তাকে বলা হয় আমেরিকান ফলস। আর বাংলাদেশ থেকে নায়াগ্রার দুরত্ব প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার।
কথিত আছে, ১৮শ’ বছর পূর্বে বরফে ঢাকা ছিল পুরো এলাকা। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে গলতে শুরু করে সেখানকার বরফ। আর সেই পানি নায়াগ্রা নদী, লেক ইরি এবং লেক ওন্টরিওর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েই সৃষ্টি হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। যার নাম দেওয়া হয় নায়াগ্রা ফলস।

পাঠক, হয়তো ভাবছেন দৈত্যকার এই প্রপাতের গভীরতা কত, কিংবা এত পানি কোত্থেকে আসছে। শুনলে অবাক হবেন ১শ’ ৬৭ ফুট উচু এই জলপ্রপাতটি। আর চওরা প্রায় ২৬শ’ ফুট। এখান থেকে প্রতি সেকেন্ডে গড়িয়ে পড়ে প্রায় ২৪শ’ ঘনমিটার পানি। মূলত অন্যান্য জলধারা পাহাড় থেকে প্রবাহিত হলেও, নায়াগ্রা কিন্তু পুরোই ব্যতিক্রম। এর পানি গড়িয়ে পড়ছে সমতল থেকে। আর কোথায় পড়ছে? হ্যাঁ দর্শক এটিও বড় এক বিস্ময়। নায়াগ্রার পানি সমতল থেকে যাচ্ছে বিশাল এক গর্তের ভেতর। আর এই গর্তের পানি কোথায় যায়, সে তথ্য আজো অধরা।
কি ভাবছেন, সৃষ্টির পর থেকেই এমনভাবে অনবরত পানির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে নায়াগ্রায়? না দর্শক। একাধিকবার প্রকৃতি থামিয়ে দিয়েছিল এই বিস্ময়কর জলরাশিকেও। ১৮৪৮ সালে তাপমাত্রা এতটাই কমে গিয়েছিল যে, বরফ হয়ে গিয়েছিল নায়াগ্রার সব পানি। যতদূর জানা যায়, প্রায় দু’দিন এক ফোঁটা পানিও পড়েছিল না নায়াগ্রা জলপ্রপাতে। এছাড়াও ১৮৮৫, ১৯০২, ১৯০৬, ১৯১১, ২০১৪, ২০১৭, ২০১৯ সালে এখানকার একটি অংশ বরফ হয়ে যাওয়ায় আংশিক থমকে গিয়েছিল পানির কলকল ধ্বনি।

এবার নিশ্চই ভাবছেন বিশাল এই জলরাশির মধ্যে যদি ঝাপ দিতে পারতাম। না মোটেও অলীক চিন্তা নয় কিন্তু। এরইমধ্যে এমন কাজ কিন্তু বেশ কয়েকজন সাহসী মানুষ করে ফেলেছেন। তাদের কয়েকজনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেও, বেশির ভাগের কপালই ছিল মন্দ। যতদূর জানা যায় নায়াগ্রার এই মোহময়ী সৌন্দর্যের টানে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৮২৯ সালে স্যামপেচ নামের একজন এর ভেতর ঝাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই যাত্রায় বেচে ফিরেছিলেন তিনি। এরপর তো নায়াগ্রা জয় অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের একরকম নেশায় পরিণত হয়েছিল। যদিও নিরাপত্তার কারণে বহু আগেই এতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
তবে মন খারাপের দরকার নেই, পাঠক। নায়াগ্রা ফলসের সৌন্দর্য পুরোপুরি আস্বাদনে কোন কমতি হবে না আপনার জন্য। প্রপাতের একেবারে সানিধ্য পেতে পারেন মেড অব দ্যা মিস্ট নামের একটি জাহাজে চড়ে। যেটি পর্যটকদের ঘুরিয়ে আনতে সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। এছাড়াও আপনি কানাডার অংশে গিয়ে নায়াগ্রার একেবারে সম্মুখভাগ দেখতে পারবেন কোনরকম বাধা ছাড়াই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেবল এর পেছনের অংশই দেখা যায়।

এখন ভাবছেন কোন সময়টাতে যাবেন নায়গ্রার অপার বিস্ময় উপভোগ করতে? সাধারণত বছরের বসন্ত থেকে শুরু করে গ্রীস্মকালই এখানে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ শীতে খানিকটা হলেও হ্রাস পায় এর স্বাভাবিকতা। বিভিন্ন জরিপের তথ্য মতে প্রতি বছর ৩ কোটি পর্যটক এই স্থানটি ভ্রমণ করে থাকেন। নায়গ্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আরো বেশ কয়েকটি পর্যটন স্থল। এখানে গেলে পাবেন প্রজাপতির মেলা, যেখানে রয়েছে প্রায় ২ হাজার ধরনের প্রজাপতি। এছাড়াও রয়েছে অ্যাকুরিয়াম, জাদুঘর, অ্যাডভেঞ্চার থিয়েটারসহ আরো কত কিছু।
নায়গ্রা যে কেবল দর্শকদের আনন্দ দেয়, তা কিন্তু নয়। প্রকৃটির এই অপার সৃষ্টি অনবদ্যভাবে অবদান রাখছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও। পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি, এখানকার স্রোত কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে বিদ্যুত। নায়াগ্রার জলবিদ্যুত কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুত পূরণ করছে নিউইয়র্ক এবং ওন্টারিওর বাসিন্দাদের চাহিদা।